প্রথম অধ্যায়
স্রষ্টা ও সৃষ্টি প্রথম পরিচ্ছেদ : স্রষ্টার স্বরূপ ও উপাসনা
যিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা, সর্বশক্তির উৎস, যার উপরে কেউ নেই, তিনিই পরম পিতা। তিনিই পরম স্রষ্টা। তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা এবং নিয়ন্তা । সনাতন ধর্ম তথা হিন্দুধর্মের চেতনায় তাঁকে নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি ব্রহ্ম, পরমেশ্বর, পরমাত্মা, আত্মা, ঈশ্বর, ভগবান ।
স্রষ্টাকে উপাসনার মাধ্যমে আমরা তাঁর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। আমাদের সকল কাজে গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ এবং তাঁর উপাসনা করা উচিত। এ অধ্যায়ে আমরা তাঁর স্বরূপ, সৃষ্টির মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা, তাঁর গুণ ও শক্তিরূপে দেব-দেবীর পরিচয়, তাঁকে উপাসনার ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা এবং উপাসনার একটি মন্ত্র বা শ্লোক সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব ।
এ অধ্যায় শেষে আমরা -
পাঠ ১ ও ২ : স্রষ্টার স্বরূপ— ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও অবতার
সনাতন ধর্ম বা হিন্দুধর্ম অনুসারে স্রষ্টাকে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও অবতার নামে অভিহিত করা হয়েছে । তাঁর স্বরূপ বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ রেখে এসকল নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ।
১.১. ব্রহ্ম ও ঈশ্বর
ব্রহ্মরূপে স্রষ্টার স্বরূপ
ব্রহ্ম শব্দের অর্থ সর্ববৃহৎ, 'বৃহত্বাৎ ব্রহ্ম' । যাঁর থেকে বড় কেউ নেই, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা এবং যাঁর মধ্যে সকল কিছুর অবস্থান ও বিলয় তিনিই ব্ৰহ্ম । ব্রহ্ম শুধু প্রকৃতি ও মহাবিশ্বকেই সৃষ্টি করেননি, বরং তিনি প্রকৃতি ও মহাবিশ্বকে তাঁর ঐশ্বরিক শক্তির মাধ্যমে রক্ষাও করে থাকেন । বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত, সর্বজ্ঞ, জ্যোতির্ময়, নিরাকার, সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান । ব্রহ্ম সর্বব্যাপী বলে তাঁকে কেউ দেখতে পায় না। আমরা জানি, ব্রহ্মকে পরমাত্মাও বলা হয়। তিনি যখন জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন, তখন তাঁকে জীবাত্মা বলে। আত্মা যখন নিজের মধ্যে অবস্থান করে তখন তাকে পরমাত্মা বলা হয় ।
ব্রহ্ম নিরাকার ও নির্গুণ এবং তিনি নিশ্চল অবস্থায় অবস্থান করেন। ব্রহ্ম বা পরমাত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই । তিনি অজ, অনাদি, অনন্ত এবং শাশ্বত । ব্রহ্মকে ‘ওঙ্কার' বলা হয় । ওঙ্কার সংক্ষেপে ওঁ । এর পূর্ণরূপ অ-উ-ম । এর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কারী ব্রহ্ম ।
ঈশ্বররূপে স্রষ্টার স্বরূপ
ব্রহ্ম যখন জীব ও জগতের উপর প্রভুত্ব করেন, তখন তাঁকে ঈশ্বর বলা হয়। ঈশ্বরকে পরমেশ্বর নামেও ডাকা হয় । তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং ধ্বংসকর্তা। ঈশ্বরের রূপের শেষ নেই । তিনি অনন্তরূপী । জ্ঞানীর কাছে তিনি ব্রহ্ম, যোগীর কাছে তিনি পরমাত্মা এবং ভক্তের কাছে ভগবান ।
ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণ-
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একটি শ্লোকে ঈশ্বর সম্পর্কে বলা হয়েছে— স্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্ । ত্বয়া ততং বিশ্বমনন্তরূপ । (১১/৩৮)
বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম
অর্থাৎ ‘তুমি আদিদেব, তুমি অনাদি পুরুষ, তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয় স্বরূপ, তুমি একমাত্র জ্ঞাতব্য এবং জ্ঞাতা । তুমি একমাত্র পরম স্থান। হে অনন্তরূপ, তুমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রসারিত' একমাত্র প্রভু । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোক থেকে সহজেই ঈশ্বরের মহিমা ও শক্তি প্রতীয়মান হয় । বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে ঈশ্বর অনন্ত অসীম, তাঁর কোনো পরিবর্তন নেই । তিনি শাশ্বত । তিনি জগতের আদি কারণ, তিনি বিধাতা । তাঁর কোনো স্রষ্টা নেই । তিনি স্বয়ম্ভু অর্থাৎ নিজে নিজেই সৃষ্ট হয়েছেন । তিনি নিত্য, শুদ্ধ ও পরম পবিত্র । তিনি সকল
কর্মের ফলদাতা। যে যেরকম কর্ম করে, তিনি তাকে সেরকম ফল দিয়ে থাকেন। ঈশ্বর নিরাকার। প্রয়োজনে তিনি সাকার হতে পারেন । কারণ অনন্ত তাঁর শক্তি। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজ করেন। ঋগবেদ অনুসারে তিনি পরম পুরুষ, তাঁর সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু, সহস্র চরণ। এ কথার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সর্বব্যাপিতাই বোঝানো হয়েছে । তিনি অদ্বিতীয় । তিনি জ্যোতিঃস্বরূপ, তিনি সকলের মধ্যে বিরাজ করেন ।
১.২. স্রষ্টার স্বরূপ : ভগবান ও অবতার
ভগবানরূপে স্রষ্টার স্বরূপ
হিন্দুধর্ম দর্শন অনুসারে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্যকে ভগ বলে। ভগ যার মধ্যে পূর্ণরূপে আছে তিনিই ভগবান। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে- যিনি ভূতগণের উৎপত্তি, বিনাশ, পরলোকে গতি, ইহলোকে আগমন এবং বিদ্যা অবিদ্যা জানেন, তিনিই ভগবান। ঈশ্বরকে যখন এই ছয়টি গুণের অধীশ্বররূপে কল্পনা ও আরাধনা করা হয় তখন ঈশ্বরকে ভগবান বলা হয় (শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, ৬। ৫। ৭৯)। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে ভগবান গুণময় এবং অশেষরূপের আধার। তিনি রসময়, আনন্দময় ও দয়াময়। তিনি তাঁর ভক্তদের বিভিন্নভাবে কৃপা করে থাকেন। ভগবানের মধ্যে ভক্ত তাঁর অভীষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারেন । ভগবান যে-কোনো রূপ ধারণ করে ভক্তকে দেখা দেন, লীলা করেন। তিনি প্রয়োজনে জীবের ন্যায় দেহধারী হয়ে তপস্যা, ধ্যান, প্রার্থনা ও সকল সুখ-দুঃখ ভোগ করেন। আবার ঈশ্বরাবেশে অপ্রাকৃত লীলা, দাবানল পান, একহাতে গোবর্ধন পর্বত ধারণ, পাষণ্ড দলন এবং কঠোর তপস্যা করে সকলকে মুগ্ধ করেন এবং সকলের মঙ্গল করেন। সামান্য দেহধারী হয়ে ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ভগবান তাঁর কাছে আসেন । প্রয়োজনে ভক্তের বোঝা তিনি বহন করেন । মোট কথা ঈশ্বর যখন জীবকে দয়া করেন। তখন তাঁকে বলা হয় ভগবান ।
অবতাররূপে স্রষ্টার স্বরূপ
হিন্দুধর্মে অবতার বলতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে স্বেচ্ছায় নিরাকার ঈশ্বরের জীব বা সাকার রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়াকে বোঝানো হয়। এই সকল অবতার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও অতিলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন । অবতার শব্দটি তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জীবরূপে মর্ত্যে ঈশ্বরের অবতরণ ।
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং ধর্ম রক্ষার জন্য ঈশ্বর নানারূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বা নেমে আসেন । যেমন নৃসিংহ, রাম, শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি ঈশ্বরের অবতার। ধর্ম অনুশীলনের ক্ষেত্রে পরম সত্তা বা পরমেশ্বর থেকে উদ্ভূত সকল অবতারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান বিষ্ণু অনেকবার অবতার হিসেবে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছেন । বিভিন্ন যুগে ভগবান বিষ্ণু নয়বার অবতার হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন । কলিযুগের শেষে তিনি কল্কিরূপে দশম অবতার হিসেবে অবতীর্ণ হবেন।
বিষ্ণুর দশ অবতার হচ্ছে -
১.মত্বস
২. কুর্ম
৩. বরাহ
8. নৃসিং
৫. বামন
৬. পরশুরাম
৭. রাম
৮. বলরাম
৯. বুদ্ধ
১০. কল্কি
কল্কি সর্বশেষ অবস্থার। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী কলিযুগের শেষের দিকে তাঁর আবিৰ্তাৰ ঘটবে।
স্রষ্টার স্বরূপ সম্পর্কে সবশেষে আমরা বলতে পারি; ব্রহ্মরূপে স্রষ্টা নিরাকার, নির্গুণ । ব্রহ্ম যখন জীব ও জগতের ওপর প্রভুত্ব করেন, তখন তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বর নিরাকার, ভবে প্রয়োজনে সাকার রূপ ধারণ করতে পারেন। ঈশ্বর যখন ভক্তের ডাকে সাড়া দেন, তাঁর কাছে আসেন, নানা রকম লীলা করেন, তখন তাঁকে বলা হয় ভগবান। আবার মঙ্গলকর কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ঈশ্বর যখন জীবরূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তাঁকে বলে অবতার। ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও অবভার আলাদা নয়, এ হচ্ছে একই সর্বশক্তিমান স্রষ্টা বা ব্রহ্মেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ।
পাঠ ৩ : স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক এবং সৃষ্টির মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় স্রষ্টার
ভূমিকা
স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন, প্রতিপালন করেন, বিপদ-আপদে রক্ষা করেন, প্রয়োজনে সৃষ্টি ও ধ্বংস করেন, দুষ্টের হাত থেকে সৃষ্টিকে রক্ষাও করেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে সৎপথে চলতে সহায়তা করেন। যাঁরা সৎপথে চলেন তিনি তাঁদের ভালোবাসেন। তাঁদের উন্নতির পথ দেখান এবং সর্বদা তাঁদের মাঝে বিরাজ করেন। অসৎ ব্যক্তিদের তিনি পছন্দ করেন না এবং শাস্তি দিয়ে থাকেন । কিন্তু সৎ ব্যক্তিদের রক্ষা করেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই অবস্থান করেন । অর্থাৎ জীবের মধ্যে এক ঈশ্বর বহুরূপে বিরাজ করেন । এ কারণে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিরাজ করছে । স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বর জীবকুলের উপর প্রভুত্ব করেন । জীব, বস্তু – সকল কিছুর তিনিই নিয়ন্ত্রক । স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টিকে যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি সৃষ্টি ছাড়া স্রষ্টাকেও ভাবা যায় না । নিচে সৃষ্টির শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় স্রষ্টার ভূমিকা বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো ।
১. অভিভাবক হিসেবে সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা
স্রষ্টা ছাড়া কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না । এ মহাবিশ্বের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, জীব-জন্তু সবকিছুর একজন স্রষ্টা আছেন । তিনি ঈশ্বর । তিনি অবিনশ্বর এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী । সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে পরিচালনা করছেন এবং রক্ষা করছেন । তিনি তাঁর সৃষ্টির জন্য জন্ম ও মৃত্যু নির্ধারণ করেছেন ।
ভালো কাজের জন্য তিনি তাঁর ভক্তদের ভালো ফল দিয়ে থাকেন এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি প্রদান করেন । আবার মহাকাশের নক্ষত্রমালা যে কক্ষচ্যুত হচ্ছে না, তার মূলেও রয়েছে ঈশ্বরের শৃঙ্খলা বিধানের শক্তি। এ সব কিছুই সৃষ্টিকর্তার আদেশে পরিচালিত হচ্ছে । ঈশ্বর ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই ত্রয়ী শক্তিরূপে বিরাজিত । ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু রক্ষা ও প্রতিপালনকারী দেবতা এবং শিব সংহারের দেবতা । এ থেকে বোঝা যায়, সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য তাঁর নির্ধারিত ভূমিকা পালন করছেন ।
২. সর্বশক্তিমান হিসেবে স্রষ্টার ভূমিকা
মহান ঈশ্বর একজন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক, একজন অসীম ক্ষমতাধর পরমপুরুষ। তাঁর রয়েছে অসংখ্য মস্তক, অনন্ত চক্ষু, অগণিত চরণ । তিনি সমগ্র বিশ্বে সর্বজীবে পরিব্যাপ্ত । লক্ষকোটি গ্রহ, উপগ্রহ এ মহাকাশে নির্দিষ্ট গতিপথে আবর্তিত হচ্ছে। জীব ও জড় বস্তু সবকিছুই একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ । পরম কারণবাদের যৌক্তিকতা থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে এক ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বিস্ময়কর শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিচালিত করছেন। কেননা, একাধিক ঈশ্বরের নিয়ম-কানুনগুলো ভিন্ন ভিন্ন হতো যা সংঘাতের সৃষ্টি করত। অতএব ঈশ্বর এ মহাবিশ্বের একজন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন । অনেক ধর্মতাত্ত্বিকের মতে, বিশ্ব কোনো কারণের ফলাফল । পৃথিবী মাটি, জল, আলো বাতাস দ্বারা গঠিত, যা কোনো পরম একক শক্তি দ্বারা সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত । ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে তা করা অসম্ভব ।
৩. দুষ্টের দমনে স্রষ্টার ভূমিকা
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ পবিত্র গীতার এ শ্লোক থেকে প্রতীয়মান হয় যে যখন এ বিশ্বে ধর্ম কমে যায়, অধর্ম বেড়ে যায় তখনই স্রষ্টা জগতে অবতাররূপে অবতীর্ণ হন । এ সময় তিনি দুষ্টকে শক্তহাতে দমন করেন ।
৪. শাসক হিসেবে ভূমিকা
ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে ভালো কাজের ফলাফল শুভ এবং মন্দ কাজের ফলাফল অশুভ। ভালো ও খারাপ অবচেতনভাবে হৃদয়ে বিরাজ করে। এই চেতনা পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন একজন শাসকের । ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। তিনি ভালো মানুষকে সুখী করেন, অপরাধীদের শাস্তি দেন এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন । অন্তরকে পরিচালিত করা, ন্যায়-অন্যায়কে নির্দিষ্ট করা ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কোনো শক্তির পক্ষে সম্ভব নয় ।
ঈশ্বর সকলের হৃদয়ে অবস্থান করেন, সকলকে পরিচালনা করেন । ঈশ্বর সকলের প্রভু, সর্বজ্ঞ, নিয়ন্ত্রক, বিশ্বের কারণ, স্রষ্টা ও ধ্বংসকারী ।
৫. জন্ম ও মৃত্যুর বিধায়ক এবং ভালো কাজের ফলদাতা
হিন্দু ধর্মের বেদান্ত দর্শন অনুসারে প্রাণী ও অপ্রাণী যে কোনো বিষয় বা পদার্থ যে-স্থান থেকে জন্মলাভ করে, মৃত্যু বা ধ্বংসের মাধ্যমে যার কাছে ফিরে যায়, তিনিই ব্রহ্ম বা অক্ষয় শক্তি বা ঈশ্বর । বেদান্তের এই উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে ঈশ্বর জীবকুলের সৃষ্টি ও মৃত্যু উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত । ঈশ্বর জন্ম ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন যাতে এ জগতের সকল প্রাণী একটা নিয়মের মধ্য দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে পরিচালিত হয় । তিনি স্বর্গ ও নরক সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ সৎ পথে ও সৎ কর্মের মধ্য দিয়ে স্বর্গলাভ করতে পারে । মন্দ কর্ম করলে নরকে যেতে হয় ।
পাঠ ৪ : ঈশ্বরের গুণ ও শক্তি : দেবদেবী
ঈশ্বর এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং সংহারকর্তা । অর্থাৎ ঈশ্বর যে তিনটি প্রধান ক্রিয়া সাধন করে থাকেন, তা হলো সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় । তিনি নিরাকার, আবার প্রয়োজনে সাকার রূপ ধারণ করেন । দেবদেবী ঈশ্বরের সাকার রূপ। ঈশ্বর নিজের কোনো গুণ বা ক্ষমতাকে কোনো বিশেষ আকার বা রূপে প্রকাশ করেন - যেমন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, সরস্বতী ইত্যাদি । এঁরা সকলেই ঈশ্বরের বিশেষ গুণ বা ক্ষমতা ধারণ করে রয়েছেন । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় : ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু পালনকর্তা, সরস্বতী বিদ্যার দেবী, শিব প্রলয়ের দেবতা ইত্যাদি । আমরা ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও শক্তি অর্জনের জন্য স্বতন্ত্রভাবে দেবদেবীর পূজা করি, ভক্তি করি, তাঁদের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করি ।
আগেই বলা হয়েছে, ঈশ্বর বা ভগবান প্রধানত ছয়টি গুণে গুণান্বিত- ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য।
দেবদেবীগণ পরিপূর্ণ ঈশ্বর না হলেও মহান ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত । কেননা, তাঁরা ঈশ্বরের এক বা একাধিক গুণ বা শক্তি ধারণ করে আছেন । এ কারণে ঈশ্বররূপে বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজা করা হয় । পূজার মাধ্যমে দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে পূজারীর অভীষ্ট পূরণ করেন ।
সুতরাং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবদেবী এক ঈশ্বরের বিভিন্ন সাকার রূপ । উদাহরণস্বরূপ নিচে
কয়েকজন দেবদেবীর ঐশ্বরিক গুণ ও শক্তির বর্ণনা করা হলো- ব্রহ্মা : ঈশ্বর যে-রূপে সৃষ্টি করেন তাঁর নাম ব্রহ্মা । তিনি বিশ্ব ও বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ব সৃষ্টি করা ছাড়াও ব্রহ্মা নাট্যশাস্ত্র, বাস্তুশাস্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রের উদ্ভাবক । তিনি কল্যাণমূলক কাজ করে থাকেন ।
বিষ্ণু : তিনি সৃষ্টির স্থিতি ও প্রতিপালনের দেবতা । এ বিশ্বে যা কিছু আছে বিষ্ণু তা পালন ও রক্ষা করেন। দেবতারা বিপদে পড়লে বিষ্ণু তাদের উদ্ধার করেন। দুষ্টকে দমন ও শিষ্টকে পা
লন করার জন্য তিনি বহুরূপে এ পৃথিবীতে অবতাররূপে আবির্ভূত হন । বিষ্ণুকে স্মরণ করলে পাপ দূরীভূত হয়, হৃদয় পৰিত্ৰ হয় ও মনে শান্তি আসে।
শিব বা মহেশ্বর : তিনি সংহার বা প্রলয়ের দেবতা। তিনি সংহার করে সমতা রক্ষা করেন। এ ছাড়াও তিনি দেবতাদের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা এবং প্রয়োজনে অসুরদের বিনাশ করেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৃত্যশাস্ত্রসহ বহু বিদ্যায় পারদর্শী। নাট্যে ও নৃত্যে পারদর্শিতার কারণে তাঁকে নটরাজ বলা হয় ।
দেবী দুর্গা : দেবী দুর্গা ঈশ্বরের শক্তিরূপ। আদ্য শক্তি মহামায়াই বিভিন্ন দেবীরূপে প্রকাশিত হয়েছেন যেমন – দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী, কাত্যায়নী প্রভৃতি। দেবী দুর্গা অসীম শক্তির দেবী, যিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার সাথে সম্পৃক্ত। দেবী দুর্গাকে এ মহাবিশ্বের মহাশক্তি হিসেবে বিশ্বাস এবং পূজা করা হয় ।
দেবী কালী : দেবী কালী শাশ্বত ক্ষমতা ও শক্তির আধার । তিনি একদিকে অন্যায় ও অশুভকে ধ্বংস করেন । অপরদিকে মমতাময়ী মা রূপে দেন বরাভয় ।
লক্ষ্মী : লক্ষ্মী সৌভাগ্য, ধন-সম্পদ এবং সৌন্দর্যের দেবী। তিনি আমাদের বিভিন্ন সম্পদ দান করে থাকেন।
সরস্বতী : তিনি বিদ্যা, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির দেবী। সরস্বতী পূজার মাধ্যমে আমরা বিদ্যাশক্তি অর্জন করতে পারি ।
গণেশ : সিদ্ধি বা সফলতার দেবতা। যে-কোনো শুভকাজে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিদ্ধিদাতা হিসেবে গণেশের পূজা করা হয় ।
কার্তিক : কার্তিক যুদ্ধের দেবতা, তিনি দেবসেনাপতি। তিনি অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আদর্শ ও সুন্দর সন্তান লাভের জন্য দেবতা কার্তিকের পূজা করা হয় ।
শীতলা : তিনি রোগ প্রতিরোধ ও শাস্তি প্রতিষ্ঠার দেবী। দেবী শীতলাকে স্বাস্থ্যবিধি পালন বা পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার দেবীও বলা হয়। শীতলা পূজার মাধ্যমে আমরা স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন হয়ে থাকি । তিনি মহামারী প্রতিরোধ ও প্রাণিকূলকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে থাকেন ।
পাঠ ৫ : উপাসনা
উপাসনার ধারণা
হিন্দুধর্মের মূলে রয়েছেন ভগবান স্বয়ং। 'ধর্মমূলো হি ভগবান, সর্ববেদময়ো হরিঃ। ঈশ্বর আছেন । তিনি এক ও অদ্বিতীয় । তিনি সকল জীবের অন্তরাত্মা । সবকিছুই তাঁর থেকে সৃষ্ট। সুতরাং ঈশ্বরই ধর্মের মূল উৎস । ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের পালন করেন। তিনি সর্বশক্তিমান । আমাদের মঙ্গল-অমঙ্গল সব তাঁর হাতে। তাই আমাদের মঙ্গলের জন্য আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই । তাঁর গুণগান করি। বিশেষ পদ্ধতিতে ঈশ্বরের গুণগান করার রীতিকে বলা হয় উপাসনা । আক্ষরিকভাবে উপাসনা বলতে ঈশ্বরের পাশে অবস্থান করাকে বোঝানো হয় ।
প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির হৃদয় ঈশ্বরের অনুকম্পা লাভের জন্য উন্মুখ থাকে । সে ঈশ্বরের
সান্নিধ্য লাভের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে । হিন্দুধর্ম অনুসারে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করাই
হলো পরম তৃপ্তি ও মুক্তির একমাত্র পথ । পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের বিভিন্ন পথের কথা উল্লেখ রয়েছে । উপাসনা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের একটি মাধ্যম বা পথ ।
উপাসনার ধরন
উপাসনা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে । যথা-
ক. সাকার উপাসনা বা প্রতীক উপাসনা
খ. নিরাকার উপাসনা বা নির্গুণ উপাসনা
সাকার উপাসনা বা প্রতীক উপাসনা : প্রতীক শব্দের অর্থ চিহ্ন বা আকার। মূলত এ ধরনের উপাসনা বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমাকে (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, সরস্বতী, লক্ষ্মী, মনসা প্রভৃতি) উদ্দেশ্য করে করা হয় । প্রতীক উপাসনা সগুণ উপাসনা বা ভক্তিযোগ নামে পরিচিত। সগুণরূপে ঈশ্বর সাকাররূপে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি প্রতিকৃতিতে প্রকাশিত। পূজা করাকে সগুণ উপাসনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
নিরাকার উপাসনা : 'নিরাকার' শব্দের অর্থ যার কোনো আকার নেই। মূলত এ ধরনের উপাসনা ধ্যান সাধনার মাধ্যমে করা হয় । জ্ঞানযোগ নিরাকার উপাসনার একটি অংশ। এ উপাসনা ঈশ্বরের কোনো প্রতিকৃতিকে উদ্দেশ করে করা হয় না । নিরাকাররূপ ঈশ্বর অদৃশ্য অবস্থায় অবস্থান করেন। তাঁকে উপলব্ধি করে তাঁর উপাসনা করা হয় ।
হিন্দুধর্মাবলম্বী কেউ নিরাকার, কেউবা সাকার উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে পূজা বা আরাধনা করেন । এ সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লেখ করেছেন :
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ । মম বর্থানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ । (গীতা ৪/১১)
অর্থাৎ যারা যেভাবে আমাকে ভজনা করে তাদের সেভাবেই আমি কৃপা করে থাকি । মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথ অনুসরণ করে। দেবদেবীগণ একই ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ। তাই হিন্দুধর্মে একের মধ্যে বহুর সমাবেশ বা বহুর মধ্যে একের অভিব্যক্তি ঘটেছে।
উপাসনার উপায়
উপাসনা করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে । এ উপায়গুলোর মধ্যে আছে পূজা করা, জপ ধ্যান বা যোগ সাধনা, তন্ত্র সাধনা প্রভৃতি । এ ছাড়াও দেব-দেবীর উদ্দেশে মন্ত্র পাঠ, প্রার্থনা মন্ত্র, পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, প্রণাম মন্ত্ৰ পাঠ, আরতিগান, কীর্তন প্রভৃতি উপাসনার উপায় হিসেবে ধরা হয়। এ বাহ্য আচরণের মাধ্যমে মূলত অন্তরের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ইষ্ট দেবতার উদ্দেশে প্রকাশ করা হয় । উপাসনা ও প্রার্থনার জন্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে অনেক মন্ত্র বা শ্লোক রয়েছে । সেগুলো আবৃত্তি করে উপাসনা করা হয় বা প্রার্থনা জানানো হয় ।
উপাসনার প্রয়োজনীয়তা
১. হৃদয় পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করা : ঈশ্বরের উপাসনা হৃদয়কে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে এবং সুন্দর অনুভূতির সৃষ্টি করে ।
২. মনের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করা : উপাসনা মনের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে, মনের আবেগকে পরিশুদ্ধ, উন্নত ও
নিয়ন্ত্রণ করে ।
৩. ভক্তদের মনে ঈশ্বরের উপস্থিতি সৃষ্টি করা : উপাসনা ভক্তদের ঈশ্বরের কাছাকাছি অবস্থানের সুযোগ করে দেয় এবং ধর্মীয় বিষয়ে গভীর চেতনার সৃষ্টি করে ।
8. মানসিক অবস্থার উন্নতি করা: উপাসনা মানুষের মানসিক অবস্থার উন্নতি করে, মনের কুটিলতা দূর করে এবং মনকে শুদ্ধ করে সত্যের পথে পরিচালিত করে। উপাসনা মনের কামনা, বাসনা, তৃষ্ণা, অহমিকা, আমিত্ব, হিংসা বিদ্বেষ দূর করে।
৫. ভক্ত ও ঈশ্বরকে মুখোমুখি করা : উপাসনার মাধ্যমে ভক্ত তার ইষ্ট দেবতাকে উপলব্ধি করতে পারে এবং গভীর ভালোবাসার মাধ্যমে সে তাকে নিজের চোখে অবলোকন করতে পারে ।
৬. মোক্ষ লাভ : মোক্ষ অর্থ চিরমুক্তি । দেহান্তরের মধ্য দিয়ে জীবাত্মা এক দেহ থেকে অন্য দেহে যায় । কিন্তু পুণ্যবলে এক সময় আর দেহান্তর হয় না। তখন জীবাত্মাকে আর অন্যদেহে যেতে হয় না । জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যায় । তখন আর পুনর্জন্ম হয় না। একে বলে মোক্ষ, মোক্ষলাভ । উপাসনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ, শেষে মোক্ষলাভ ।
পাঠ ৬ : ঈশ্বর উপাসনার একটি মন্ত্র বা শ্লোকের অর্থ ও শিক্ষা
উপাসনার একটি মন্ত্র :
যস্মাৎ পরং নাপরমস্তি কিঞ্চিদ্
যস্মান্নাণীয়ো ন জ্যায়ো হস্তি কিঞ্চিৎ । বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেক- স্তেনেদং পূর্ণং পুরুষেণ সর্বম্ ॥ (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৩/৯)
সরলার্থ : যা থেকে উৎকৃষ্ট বা অপকৃষ্ট আর কিছু নেই, যা থেকে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই, যে অদ্বিতীয় পরমাত্মা বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে স্বমহিমায় বিরাজিত, সেই পুরুষের দ্বারাই সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত।
উপাসনার শিক্ষা : এ শ্লোক থেকে আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তা হলো- ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কিছুই নেই । তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি নিজ গুণে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এ বিশ্ব জগতে বিরাজ করছেন । তিনি ছাড়া এ জগতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই অর্থাৎ ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় । আমাদের উচিত সবসময় ঈশ্বরের নাম জপ করা বা প্রতিদিন একবার ঈশ্বরের মন্ত্র বা শ্লোক পাঠ করা, যাতে আমাদের মনে ঈশ্বরের মহত্ত্ব সর্বদাই পরিব্যাপ্ত থাকে ।
প্ৰাৰ্থনা মন্ত্ৰ
কেশব ক্লেশহরণ নারায়ণ জনার্দন । গোবিন্দ পরমানন্দ মাং সমুদ্ধর মাধব
সরলার্থ : হে কেশব, হে দুঃখদূরকারী, হে নারায়ণ, হে জনার্দন, হে গোবিন্দ-পরমানন্দ, হে মাধব আমাকে উদ্ধার কর ।
শিক্ষা
ভগবান বিষ্ণুই শ্রীকৃষ্ণ । তিনি জীব ও জগতের মঙ্গলের জন্য অনেক লীলা করেছেন । দুষ্টের দমন করে ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন, শান্তি স্থাপন করেছেন । তাঁর অনেক নাম : কেশব, নারায়ণ, জনার্দন, গোবিন্দ, মাধব ইত্যাদি । তিনি সবসময় আনন্দময় থাকেন, সুখ বা দুঃখে তিনি বিচলিত হন না । তাই তিনি পরমানন্দ । তিনি জীব ও জগতের দুঃখ হরণ করেন, অর্থাৎ দূর করেন । আমরা জীবেরা অনেক সময় জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এমন কাজ করি, যাতে পাপ হয় । তাই আমাদের পাপ ক্ষমা করে উদ্ধার করার জন্য আমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাই। এ প্রার্থনা মন্ত্র থেকে আরও শিক্ষা পাই যে, ঈশ্বরের কাছে পাপমুক্তির জন্যও প্রার্থনা করতে হয় ।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১। কলিযুগের অন্তে অবতার হিসেবে কার আবির্ভাব ঘটবে?
ক. কূর্ম
গ. বামন
খ. বরাহ
ঘ. কল্কি
২। ঈশ্বরের সাকার রূপ কারা?
ক. মুনি-ঋষি
গ. যোগী-সন্ন্যাসী
খ. দেব-দেবী
ঘ. সাধক-সাধিকা
৩। রোগ প্রতিরোধকারী দেবী কে?
খ. দুর্গা
ক. লক্ষ্মী
ঘ. শীতলা
গ. কালী
৪। পরমাত্মার মৃত্যু নেই, কারণ পরমাত্মা -
i. সাকার
ii. মৃত্যুহীন
iii. জন্ম ও মৃত্যুহীন
নিচের কোনটি সঠিক?
খ. ii
ক. i
গ. iii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৫ ও ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও । সুমিতা দেবী ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় গভীর ধ্যানে মগ্ন থেকে ঈশ্বরের উপাসনা করেন । তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য মোক্ষলাভ ।
৫ । সুমিতা দেবী কোন ধরনের উপাসনা করেন?
ক. সাকার
গ. সকাম
খ. নিরাকার
ঘ. সমবেত
৬। নিয়মিত উপাসনার ফলে সুমিতা দেবীর -
i. হৃদয় পরিশুদ্ধ ও পবিত্র হবে ii. মনের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে
iii. ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশা পূরণ হবে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. i ও ii
ঘ. i, ii ও iii
গ. ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন :
শুভ্র ও তার মায়ের কথপোকথন-
শুভ্র -মা, দিনের পর রাত, রাতের পর দিন হয় কেন? দাদু মারা গেলেন কেন?
মা -এটি মহাবিশ্বের একটি নিয়ম। এর মূলে রয়েছেন স্রষ্টা । তাঁকে আমরা ঈশ্বর বলি।
শুভ্র -মা, ঈশ্বর কে? ব্রহ্মা, শিব না বিষ্ণু ?
মা -এঁরা সকলেই এক ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও শক্তি এবং ঈশ্বরের সাকাররূপের প্রতিফলন । তাই
আমরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করি ।
ক. বিষ্ণুর সর্বশেষ অবতার কোনটি ?
খ. উপাসনা বলতে কী বোঝায়?
গ. অনুচ্ছেদে শুভ্রের প্রশ্নের জবাবে তার মা স্রষ্টার কোন ভূমিকার কথা ব্যক্ত করেন তা তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. শুভ্রের মায়ের শেষোক্ত কথাটি— 'ঈশ্বরের সাকার রূপের প্রতিফলন'- বিশ্লেষণ কর ।
প্রথম অধ্যায়
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : স্রষ্টা, সৃষ্টি ও সেবা
পূর্ব পরিচ্ছেদে আমরা স্রষ্টার স্বরূপ ও উপাসনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। এ পরিচ্ছেদে স্রষ্টা, সৃষ্টি ও সেবা সম্পর্কে জানব । ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন । তিনি সকল কিছুর নিয়ন্তা । তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর আদি নেই, অন্ত নেই । তাঁকে চোখে দেখা যায় না, তিনি নিরাকার । তিনিই জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন । তাই জীবকে সেবা করলে ঈশ্বরের সেবা করা হয়। এ অধ্যায়ে আমরা সকল সৃষ্টির মূলে ঈশ্বর, জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বরের অবস্থান, এ সম্পর্কে একটি শ্লোক ও কবিতা এবং ঈশ্বর জ্ঞানে জীবসেবা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব ।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
পাঠ ১ : সকল সৃষ্টির মূলে ঈশ্বর সুনীল আকাশ, পৃথিবী ও পৃথিবীর প্রকৃতি— সব মিলিয়ে বিচিত্র এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। অনন্ত আকাশজুড়ে বিরাজ করছে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্রমণ্ডলী । পৃথিবীতে রয়েছে সমুদ্র, মহাসমুদ্র, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গাছ- পালা, আলো-বাতাস ও বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু । সবকিছু মিলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড । আদিতে এ মহাবিশ্ব ছিল না । তখন সব ছিল অন্ধকার। তারপর এল আলো, জল এবং জলের পরে পৃথিবী। পৃথিবীর পরে এল গাছ-পালা, কীট-পতঙ্গ, জীবজন্তু, মানবকুল প্রভৃতি । এ সবকিছু সৃষ্টির মূলে রয়েছেন ঈশ্বর । গীতায় বলা হয়েছে, তিনি পরমাত্মা এবং একমাত্র আশ্রয় । এ বিশ্বে জীবকুল সৃষ্টির মূলে রয়েছেন ঈশ্বর । আবার তিনিই জীবদেহের মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী জীবাত্মা হিসেবে বিরাজ করছেন । তিনি জীবের জীবন, প্রাণীর প্রাণ, সর্বভূতের সনাতন বীজ। জীবদেহের ভেতরে যে জীবন আছে তা পরমাত্মারই অংশ । আত্মা ছাড়া জীবদেহ অচল, মৃত । তিনি জীবের জন্ম ও মৃত্যুর কারণ । কথাটি আরও একটু বুঝিয়ে বলি : জীবদেহের মধ্যে যখন ঈশ্বর আত্মারূপে প্রবেশ করেন, জীবদেহ তখন চেতনাসম্পন্ন হয়, সচল, সক্রিয় হয়। যতদিন জীবাত্মারূপে তিনি জীবদেহে অবস্থান করেন, ততদিনই জীবের জীবন বা আয়ু থাকে । জীবাত্মা জীবদেহ পরিত্যাগ করলে জীবের মৃত্যু ঘটে এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহের বিনাশ ঘটে । তাই বলা হয়েছে ঈশ্বরই আমাদের জন্ম ও মৃত্যুর কারণ। তিনিই আমাদের চিন্তা, চেতনা ও সকল প্রচেষ্টার নিয়ন্তা ।
ঈশ্বর মানুষ ও জীবজন্তুর কল্যাণে অফুরন্ত সৌন্দর্যে ও সম্পদে ভরপুর এ সুন্দর পৃথিবী ও প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। এ প্রকৃতিতে বিরাজ করছে কত রকমের ফুল, কত রকমের ফল। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাঁরই সৌন্দর্য । সৌন্দর্য সৃষ্টির মূলেও ঈশ্বর রয়েছেন ।
পাঠ ২ : আত্মারূপে ঈশ্বর
স্রষ্টা বা ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা স্রষ্টাকে ব্রহ্ম, ঈশ্বর বা ভগবান বলে অভিহিত করেন। জ্ঞানীদের কাছে ঈশ্বর ব্রহ্ম, যোগীদের কাছে পরমাত্মা এবং ভক্তের নিকট ভগবান নামে পরিচিত । পরমাত্মা জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন । পরমাত্মা যখন জীবের মধ্যে অবস্থান করেন, তখন তিনি জীবাত্মার রূপ ধারণ করেন । এই পরমাত্মা থেকেই জীবের সৃষ্টি । আত্মা নিত্যবস্তু ও নিরাকার । আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই । একই পরমাত্মা বহু আত্মারূপে জীবদেহের মধ্যে অবস্থান করেন। জীবদেহের বিনাশ আছে, কিন্তু আত্মার বিনাশ নেই । কারণ জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশবিশেষ । পরমাত্মার সকল গুণই জীবাত্মার
মধ্যে বিদ্যমান । তাই পরমাত্মার ন্যায় জীবাত্মাও জন্ম-মৃত্যুহীন এবং শাশ্বত । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আত্মার সৃষ্টি বা বিনাশ কোনটিই সম্ভব নয় । ইনি নিত্য বিদ্যমান । ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাণ । শরীরের বিনাশ ঘটলেও, ইনি বিনষ্ট হন না
(গীতা, ২/২০) । আত্মার দেহান্তর ঘটে । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহাতি নরোঽপরাণি । তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী' (২/২2)
অর্থাৎ মানুষ পুরাতন কাপড় পরিত্যাগ করে যেমন নতুন কাপড় পরিধান করে, আত্মাও তেমনি পুরাতন দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশ করে । আত্মার এই দেহ পরিবর্তনকে জন্ম ও মৃত্যু বলে ।
দেহ ও আত্মার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে । দেহকে আশ্রয় করে আত্মার অভিযাত্রা । আবার আত্মাকে লাভ করে দেহ সজীব । দেহহীন আত্মা নিষ্ক্রিয়, আত্মাহীন দেহ জড় । অর্থাৎ জড় বস্তুর আত্মা নেই, তাই নিশ্চল, প্রাণহীন ও ক্রিয়াহীন । আত্মার জন্ম ও মৃত্যু নেই । গীতায় শ্রীকৃষ্ণের উক্তিতেও জানা যায়-আত্মা জন্মহীন, মৃত্যুহীন শাশ্বত, পুরাতন হয়েও চিরনতুন ।
পাঠ ৩ : জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বরের অবস্থান সম্পর্কিত একটি মন্ত্র বা শ্লোক এবং
ঈশ্বরের অবস্থান সম্পর্কিত কবি রজনীকান্ত সেন-এর গীতিকবিতা
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে :
অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ। অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ ॥ (১০/20 )
সরলার্থ : হে অর্জুন! আমি সকল প্রাণীর হৃদয়স্থিত আত্মা, আমি ভূতসকলের আদি, মধ্য ও অন্ত ।
শিক্ষা : এখানে আদি বলতে জীব-জগতের উৎপত্তি, মধ্য বলতে তাদের স্থিতি এবং অন্ত বলতে তাদের মৃত্যু বোঝানো হয়েছে । ঈশ্বরই জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করছেন । একথা উপলব্ধি করে আমরা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব এবং জীবকে ঈশ্বরজ্ঞানে ভালোবাসব ও সেবা করব । উল্লিখিত শ্লোকের আলোকে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি-
আছ অনল-অনিলে
চির নভোনীলে
ভূধর সলিল গহনে,
আছ বিটপী লতায়
জলদের গায়
শশী তারকায় তপনে ।
ব্যাখ্যা : উল্লিখিত কবিতাংশটি রজনীকান্ত সেন-এর একটি গীতিকবিতার অংশ । এখানে সবকিছুর মূলে ঈশ্বরের অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে । ঈশ্বর তাঁর সকল সৃষ্টি ও সৌন্দর্যের মধ্যে অবস্থান করেন । কবি রজনীকান্ত সেন-এর এ গীতিকবিতায় তিনি ব্যক্ত করেছেন যে নিরাকার ঈশ্বর অনল অর্থাৎ অগ্নি, বায়ু ও
সুনীল আকাশে আছেন । এর অর্থ হচ্ছে - অগ্নির যে দাহিকা শক্তি, তা ঈশ্বরের শক্তি। বায়ু ঈশ্বরেরই সৃষ্টি । বায়ুর যে গতি, তার মূলে রয়েছে ঈশ্বরের শক্তি । আমাদের মাথার ওপরে যে সুনীল আকাশ, ঈশ্বর সেখানেও আছেন নীলিম সৌন্দর্যরূপে । একইভাবে ভূধরে মানে পর্বতের দৃঢ়তা, উচ্চতা ও মৌনতার মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় । আবার ঈশ্বর আছেন জলের গভীরতায় । তিনি বৃক্ষ, লতা, মেঘ, চন্দ্ৰ, সূর্য ও তারকারাজির মধ্যেও বিরাজিত আছেন। এ সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি। তিনি তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করছেন। রজনীকান্ত সেন এ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন যে, ঈশ্বর সকল কিছুর মূলে অবস্থান করছেন । তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিজের মহিমা ও সৌন্দর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন । তাই ঈশ্বরের সৌন্দর্যেই সকল কিছু সুন্দর। তাঁর শক্তিতেই সকল কিছু শক্তিমান ।
পাঠ ৪ : ঈশ্বরজ্ঞানে জীবসেবা
সাধারণ অর্থে ‘সেবা' বলতে পরিচর্যা করা বোঝায়। যেমন- অতিথি সেবা, জীবসেবা, ঈশ্বর সেবা প্রভৃতি। অপরের সন্তোষ বিধানের জন্য দেহ ও মনের সমন্বয়ে কল্যাণকর যে কাজ করা হয় তাকে সেবা বলে। জীবসেবা বলতে জীবের পরিচর্যা, সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করাকে বোঝায়। এ ছাড়াও বুদ্ধি দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, সহানুভূতি জানিয়ে, বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে নানাভাবে সেবা করা যায়। আমরা জীবের সেবা করব কেন? আমরা জানি, ঈশ্বর জীবাত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই জীবসেবা করলে ঈশ্বরকে সেবা করা হয়।
জীবের সেবা করা হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান ব্রত হিসেবে বিবেচিত। 'যত্র জীবঃ তত্র শিবঃ'। অর্থাৎ যেখানে জীব সেখানেই শিব। এখানে শিব বলতে ঈশ্বরের কথাই বোঝানো হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন :
'বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।'
এ কথার তাৎপর্য এই যে, বহুরূপে অর্থাৎ বহুজীবরূপে ঈশ্বর আমাদের সম্মুখেই আছেন। তাই তাঁকে খুঁজে বেড়ানোর দরকার নেই। যিনি জীবকে ভালোবাসেন, তিনি সেই সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরেরই সেবা করেন। তাই হিন্দুধর্মে জীবকে ঈশ্বর বা ব্রহ্মজ্ঞানে সেবা করতে বলা হয়েছে। কারণ জীবকে সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা
করা হয়।
সুতরাং ঈশ্বর জ্ঞানে জীবসেবা হিন্দুধর্মের একটি মূল বৈশিষ্ট্য এবং অন্যতম নৈতিক শিক্ষা।
হিন্দুধর্মে বৃক্ষ একটি জীব। বৃক্ষের মধ্যে প্রাণরূপে ঈশ্বর বিরাজিত। তাই বৃক্ষের সেবা বা পরিচর্যা করার
বিষয়টিকে হিন্দুধর্মে প্রাচীন কাল থেকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আহারের শেষে কিছু অংশ বিভিন্ন প্রাণীর জন্য সংরক্ষণ করা হয় । এই অংশ জীবকে দেওয়া হয়। এভাবেও জীবসেবা হয়। হিন্দুধর্মে জীবসেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সেবাশ্রম, মঠ গড়ে উঠেছে যা মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের
সেবা প্রদান করছে। বিভিন্ন উপায়ে জীবসেবা করা হচ্ছে ।
সকল জীবের মধ্যে প্রাণরূপে ঈশ্বর বিরাজিত এবং ঈশ্বরের সত্তা প্রকাশিত। আমরা এ সত্য উপলব্ধি করে, সব ভেদাভেদ ভুলে জীবের সেবা করব।
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১। ‘আত্মা জন্মহীন মৃত্যুহীন শাশ্বত, পুরাতন হলেও চির নতুন' – কে বলেছেন? -
ক. শ্রীচৈতন্যদেব গ. শ্ৰীকৃষ্ণ
খ. শ্রীবিজয়কৃষ্ণ ঘ. শ্রীরামকৃষ্ণ
২। ভক্তদের কাছে ঈশ্বর কী নামে পরিচিত?
খ. বৈষ্ণব ঘ. পরমাত্মা
ক. ব্ৰহ্ম গ. ভগবান
৩ । জীবকে ভালোবাসার মূল কারণ হচ্ছে –
i. যেখানেই জীব সেখানেই শিব iii. জাগতিক কল্যাণ হয়
ii. ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii গ. ii ও iii
খ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও :
অতীন্দ্র বাবু প্রতিদিন দুপুরে আহারের সময় একমুঠো ভাত তাঁর কুকুরকে দিতেন ।একটি একসময় কুকুরটি তাঁর খুব ভক্ত হয়ে ওঠে ।
৪ । অতীন্দ্র বাবুর আচরণে হিন্দুধর্মের কোন মূল বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটেছে?
ক. পশুপ্রীতি গ. কর্তব্যনিষ্ঠা
খ. জীবসেবা
ঘ. অন্নদান
৫। অতীন্দ্র বাবুর পক্ষে ঈশ্বরকে ভালোবাসা সম্ভব, কারণ তাঁর বিশ্বাসে রয়েছে ঈশ্বর—
i. সকল সৃষ্টির মূল
ii. মহাবিশ্বের নিয়ন্তা
iii. আত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন
নিচের কোনটি সঠিক?
খ. i ও iii
ক. i ও ii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন :
মৌমিতার বোনের জন্মের সাত দিন পরেই তার ঠাকুরমার মৃত্যু হয় । প্রিয় ঠাকুরমাকে হারিয়ে সে একা হয়ে পড়ে এবং মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলে মা তাকে জীবাত্মা সম্পর্কে একটি ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য বুঝিয়ে বলেন । মৌমিতা তা উপলব্ধি করতে পেরে শ্রদ্ধায় ঈশ্বরের প্রতি মাথা নত করে ।
ক. ব্রহ্ম থেকে কী সৃষ্টি হয়েছে?
খ. ঈশ্বরকে কেন আদি শক্তি বলা হয়?
গ. অনুচ্ছেদে মৌমিতার মা কোন ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য তুলে ধরেন তা তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর
আলোকে ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. মৌমিতার উপলব্ধিটি তোমার পঠিত বিষয়বস্তুর আলোকে মূল্যায়ন কর ।
আরও দেখুন...